ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

উমেদারের দিন শেষ!

cnঅনলাইন ডেস্ক :::

সরকারি দপ্তরে মোগল আমলে চালু হওয়া উমেদারি প্রথার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে চতুর্থ শ্রেণির পদে চাকরি পাওয়ার আশায় বিনা বেতনে কাজ করা উমেদার আর রাখা হচ্ছে না সরকারি অফিসে। কয়েকটি কালেক্টরেট, ভূমি অফিস ও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স থেকে উমেদার উচ্ছেদের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন এসি ল্যান্ড ও তহশিল অফিস থেকে উমেদারদের বের করে দিতে রীতিমতো অভিযানে নেমেছেন। তাঁর নির্দেশে কয়েকজন উমেদারকে গ্রেপ্তার করে সাজাও দেওয়া হয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালতে। উমেদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে ঢাকা রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সেও।

অবসরপ্রাপ্ত জেলা নাজির আবুল কালাম জানান, প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ‘উমেদার’ এক বিচিত্র চরিত্র। শত শত বছর ধরে উমেদাররা জেলা কালেক্টরেট, এসি ল্যান্ড অফিস, তহশিল অফিস, আদালত ভবন, সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও রাজস্ব বিভাগের বিভিন্ন দপ্তরে কাজ করলেও বিনিময়ে তাঁরা বেতন পান না। বিভিন্ন আউট সোর্সিং থেকে তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বর্তমানে একই নিয়মে তাঁদের পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে। আর বেতন না পাওয়ার অজুহাতে নানা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন অনেক উমেদার। তাঁদের মাধ্যমে অফিসগুলোয় ব্যাপক দুর্নীতি ও জালিয়াতি হয়ে থাকে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি অফিসে বহিরাগত কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না। এ ধরনের কাউকে কালেক্টরেটে কিংবা ভূমি অফিসে পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে কাজে কিছুটা সমস্যা হলেও পরে ঠিক হয়ে যাবে। কারণ জেলা প্রশাসন থেকে জনবল বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ধরনের একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তা অনুমোদন লাভ করলে নতুন করে কর্মচারী নিয়োগ করে জনবল সংকট নিরসন করা হবে।

ঢাকা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অভিজ্ঞ উমেদাররাও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে নিয়োগ পেতে পারবেন। নতুন কর্মচারী নিয়োগে কোনো রকম দুর্নীতি করতে দেওয়া হবে না। প্রকৃত যোগ্য প্রার্থীরাই চাকরি পাবেন। উমেদাররা কাজে অভিজ্ঞ হওয়ায় নিয়োগ পেতে তাঁদের সুবিধা বেশি হবে।

ঢাকা রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে উমেদারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার জন্য অভিযান শুরু হচ্ছে। জেলা রেজিস্ট্রার এ বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। বিভিন্ন জালিয়াতি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত উমেদারদের একটি তালিকা করা হচ্ছে। সত্যতা যাচাই করে তাঁদের কমপ্লেক্স থেকে বের করে দেওয়ার চিন্তা আছে।

জেলা রেজিস্ট্রার দীপক কুমার সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক উমেদারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। বর্তমানে অভিযোগ যাচাই করা হচ্ছে। অচিরেই ওঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিভিন্ন ভূমি অফিস ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে উমেদারদের কাজ করার জন্য চেয়ার-টেবিল থাকলেও তাঁদের হাজিরা খাতায় সই করতে হয় না। অফিসের কোথায় কোন রেজিস্ট্রার বা নথি রয়েছে সবই তাঁদের জানা। কিন্তু বেতন-বোনাস কোনোটাই তাঁদের ভাগ্যে জোটে না।

৪০ বছর ধরে কোতোয়ালি তহশিল অফিস ও কোর্ট-কাচারিতে উমেদার হিসেবে কাজ করছেন ৭১ বছর বয়সী আবু মিয়া। তিনি বলেন, ‘উমেদার হিসেবে কাজ করে জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। যত দিন জানে কুলাবে তত দিন কাজ করে যাব। একসময় হয়তো জীবনীশক্তি হারিয়ে ঘরে চলে যাব। কিন্তু কোনো পেনসন পাব না। কেউ ফেয়ারওয়েলও দেবে না। উমেদার পরিচয়েই হয়তো একদিন মাটির নিচে চলে যাব। ’

একাধিক প্রবীণ উমেদার জানান, কয়েক বছর আগে বিভিন্ন জেলা প্রশাসনে উমেদারদের বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য সেখানে উমেদারদের জন্য আলাদা ফাইল খোলা হয়েছিল। কিন্তু পরে সে ফাইলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই উমেদারদের আপদকাল শুরু। নানা অজুহাতে তাদের অফিস থেকে বিনা নোটিশে বের করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে হয়।

ভূমিবিষয়ক গবেষক ও লেখক কাবেদুল ইসলামের মতে, ‘উমেদার’ শব্দটি ফারসি শব্দ ‘উম্মিদ’ থেকে এসেছে। এর অর্থ—প্রত্যাশা, বিশ্বাস প্রভৃতি। মোগল আমলে এ দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল ফারসি। এ কারণে উম্মিদ শব্দের সঙ্গে ‘দার’ যুক্ত হয়ে ‘উম্মিদদার’ হয়েছে। উম্মিদদার অর্থ—প্রত্যাশাকারী বা সাহায্যপ্রার্থী। উম্মিদদার শব্দটি কালক্রমে উমেদার শব্দে পরিণত হয়েছে। কার্যত কালেক্টরেট বা কাচারিতে ভবিষ্যতে চাকরি পাওয়ার প্রত্যাশায় আপাতত অবৈতনিক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বিশেষই হলো উমেদার।

বর্ষীয়ান আব্দুল খালেক ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলা কালেক্টরেটে উমেদার হিসেবে কাজ করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘অতীতে উমেদার হিসেবে কাজ শিখে অনেকেই বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চতুর্থ কিংবা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরি পেয়েছে। কিন্তু সময় যত ঘনিয়ে এসেছে ততই এ নিয়ম ভেঙে গেছে। এখন আর অভিজ্ঞ উমেদার থেকে কেউ নিয়োগ পাচ্ছে না। সব কিছু নির্ণয় হচ্ছে অর্থ লেনদেন কিংবা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে। ’

পাঠকের মতামত: